Wednesday, August 13, 2008

দাদার সাথে একটি সপ্তাহ- পর্ব ১

বেশ কিছু দিন থেকেই দাদা আমার বাসায় আসার পরিকল্পনা করছিলেন। সুযোগ হচ্ছিল না, তার উপরে সকলের বারণ আপনার এই শরীর নিয়ে ৫ তলায় ওঠা নামা করা সমস্যা হবে। তারপরও দাদা সুযোগ বুঝে ঢাকায় আসার মনস্থির করলেন। সফর সঙ্গী দাদী এবং আমার ছোট ভাই।

সবারই চিন্তা ছিল দাদা কিভাবে ৫ তলায় উঠবেন। আমি অবশ্য অতটা ভাবিনি। আমি দাদাকে মোটামুটি জানি; দাদা যদি মনে করেন তিনি উঠতে পারবেন না..... তাহলে কারও অনুরোধেই তিনি উঠবেন না; আর যদি মনে করেন তিনি উঠবেন তবে ঠিকই তিনি তা করবেন। ফুফু চেয়ার নিয়ে নিচে নামতে নামতে দাদা চার তলা উঠে বলছেন চেয়ারটা দাও একটু বসি। ফোনে খবর নিলাম দাদা ঠিকঠাক মত বাসায় পৌঁছেছেন।

ঐদিন বাসায় ফিরতে একটু রাত হলো। এসে দেখি দাদাকে ঘিরে সবাই গল্প করছে। ঢাকা শহরের গল্প.....ঢাকা শহরের দৈর্ঘ্য প্রস্থ জানতে চেয়েছেন, কেউ জবাব দিতে পারেনি! দাদা প্রথম ঢাকায় আসেন ১৯৫১ সালে। একায় আসেন। ঢাকায় ঠাঁই দেয়ার মত কেউ ছিল না। সচিবালয়ের সামনের রাস্তায় হাঁটছিলেন, এক লোকের সাথে দেখা। ঢাকায় পরিচিত কেউ নেই শোনাতে ঐদিন দাদাকে ভদ্রলোক আশ্রয় দিয়েছিলেন।

বাসায় কোরআন শরীফ খুঁজছিলেন। দাদা সাধারণত তাফহীমুল কুরআনের খন্ড পড়ে অভ্যস্ত। আমার কাছে পুরো কুরআন শরীফ একসাথে থাকলেও খন্ডগুলি ছিল না। দাদার জন্য খালার বাসা থেকে কয়েক খন্ড আনালাম। দাদা থাকাকালীন সপ্তাহটি বেশ মজার কেটেছে। অফিস থেকে ফিরেই বারান্দায় গিয়ে দাদার পাশে বসে দখিনা বাতাস খেতে খেতে গল্প করতাম।

দাদা কোথাও যেতে পারবেন না বিধায় ঢাকায় থাকা আত্নীয়রা প্রায় দিনই আমার বাসায় আসতেন। বাসাটা বেশ জমে থাকত।

খুররম জাহ মুরাদের 'কুরআন অধ্যয়ন সহায়িকা' বইটা দাদা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়লেন। এই লেখকের লেখা দাদার এমনিতেই পছন্দ, বইটি পড়ে লেখকের খুব প্রশংসা করলেন। এই বইটি এবং তাঁর আরেকটি পছন্দের বই 'ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা' তাঁকে কিনে দিলাম। আমার একটি বই ছিল- "তাফহীমুল কুরআনের বিষয় নির্দেশিকা"...... বইটি দেখে দাদা বললেন, এটা দিয়ে তুমি কি কর? বললাম, মাঝে মধ্যে দ্রুত রেফারেন্স খুঁজে পেতে কাজে লাগে। দাদা যে বইটি পছন্দ করেছেন এবং চাচ্ছিলেন- সেটা বুঝতে পেরে দাদাকে বললাম আপনি এটা নিয়ে যাবেন যাওয়ার সময়। দাদা খুশী হলেন।

দাদা ৩০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম দিয়েছেন মজবুত ঈমানের চেতনা। বইটিতে দুস্থদের প্রতি ইসলামের আবেদনটাকে বেশ জোর দিয়েছেন। দাদা মনে করেন এঁদের জন্য কাজ করা ঈমানের দাবী। সেই হাদীসটির কথাও স্মরণ করে দিলেন, সে-ই ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেট পুরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে। ভাবা যায়! প্রতিটা মানুষ মুমিন হলে কোন অভাব থাকতে পারে?

গল্পে গল্পে অনেক কথা হচ্ছিল দাদার সাথে। তাঁর মাথায় নতুন আরেকটি বিষয় ঢুকেছে। আল্লাহর আইন অনুযায়ী দেশ শাসন করলে সে দেশে কোন সংকট থাকে না, এটা কুরআনের চ্যালঞ্জ। অনেকে বলেন, ইসলামী বিধি-বিধান মত চলতে গেলে অমুকের সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে, এই সমস্যা হবে সেই সমস্যা হবে। কিন্তু কুরআন এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে। কুরআনে নাকি বেশ কয়েক জায়গায় বিষয়টা স্পষ্ট করেই বলা আছে। কুরআনের শাসন মানলে ফুল-ফসলে ভরা একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

গ্রামে দাদার প্রতিষ্ঠিত একটা সংগঠন আছে, নাম ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ। এই সংগঠনের মুল কাজ দুস্থ-অসহায় এতিম বিধবাদের জন্য কাজ করা। এবারের রমজানে তাঁর কি পরিকল্পনা সেটা বললেন। ৫০ জনকে বাছাই করে তাদের প্রত্যেককে ২৫ কেজি চাল, দুই কেজি আলু, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি সেমাই, ইত্যাদি দিবেন। এ কাজে তাঁর খরচ হবে ৪০ হাজার টাকা। ইতোপূর্বে, গত শীতে ৮০টি পরিবারে লেপ, ৪০ টিকে মশারি দিয়েছিলেন। গত তিন বছরে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। দাদা এসব কাজ করে খুব আনন্দ পান। অনেকে এসবকে বাড়াবাড়ি মনে করেন, তবে খুব কমই তিনি এসব সমালোচনাকে আমলে আনেন। দাদা আফসোস করে বলছিলেন, বড়লোকদের টাকার প্রতি মায়া খুব বেশি।

এসবের পরও দাদার মন খুব একটা তুষ্ট নয়। দাদার মতে অভাবী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। দাদাকে বললাম, এভাবে হবে না। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দাদা বললেন, সে প্রচেষ্টাও চলেছে। সুদমুক্ত কর্য দিয়েছি। কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেছে, তবে বেশির ভাগই টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। কে আবার ২০ টাকার জন্য ২০০ টাকার মামলা লড়তে যাবে? দাদাকে বললাম, সিস্টেম বের করতে হবে। সে রাতে দাদার আর ঘুম হয়নি!

দাদার ইচ্ছা- তাঁর ইউনিয়নে কোন অভাবী মানুষই রাখবেন না। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব নিয়ে দাদা বাড়াবাড়ি করছেন। দাদাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, বাকারার শেষ আয়াত..... আমি কারও উপরই তাঁর সামর্থের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়নি। দাদা জবাবে বললেন, শুধু বাকারায় না আরও বেশ ক'টি জায়গায় আছে বিষয়টি। আমি বাড়াবাড়ি করছি না, আমার যতটুকু সামর্থ ততটুকুই করি।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

1 comment:

নিঝুম said...

আপনি অনেক ভাগ্যবান :-(