Friday, August 15, 2008

দাদার সাথে একটি সপ্তাহ- পর্ব ২

দাদা একবার উনার প্রতিষ্ঠান থেকে একটা পরীক্ষা নিয়েছিলেন। ১৪ জন আলেম পরীক্ষায় অংশ নেন যারা সকলেই মাদ্রাসার বিভিন্ন পর্যায় পার করে এসেছেন। সমাজে আলেম হিসাবে পরিচিতি আছে। প্রথম প্রশ্নে বলা হয়েছিলো কালেমা তাইয়্যেবা আরবীতে লিখে তার অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা লিখতে। দাদা দুঃখ করে বলছিলেন ১৪ জনের একজনও শুদ্ধ করে কালেমা তাইয়্যেবা লিখতে পারেননি।

দাদার মতে, যেকোন সমস্যা তৈরি হলে তা দ্রুত সমাধান করতে হবে। এসব ব্যাপারে কালক্ষেপণ করা যাবে না। আগুনে বাতাস লাগার আগেই তা নিভিয়ে ফেলতে হবে। নইলে বড় ক্ষতির আশংকা আছে। পরিবারে সমস্যা তৈরি হলে কিভাবে তার সল্যুশন হবে...... এমন একটা উদাহরণ আমাকে শোনালেন। দাদার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বাড়ীর বড় ছেলেকে যদি 'মানুষ' করা যায় তবে অন্যদের 'মানুষ' করতে বেগ পেতে হয় না।

আল্লাহকে না মানার মধ্যেই আসলে সব সমস্যা। কুরআনকে বুঝতে না পারা, দ্বীনকে বুঝতে না পারায় হচ্ছে সকল সমস্যার উৎস। নইলে কোন সমস্যায় আসলে সমস্যা নয়। দাদার মতে, নতুন করে কুরআন থেকে অনেক ম্যাসেজ পাচ্ছেন। আফসোস করে বলছিলেন, এসব যদি বয়স থাকতে বুঝতে পারতাম, অনেক কিছু করার ছিল। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করি, আপনি যা বুঝছেন আমাদের শিখিয়ে দিন.... আমরা চেষ্টা করব।

সপ্তাহান্তে দাদা অস্থির হয়ে পড়লেন। তার আর মন টিকল না। সময়গুলো যেন দাদার কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। ঢাকায় থেকে তাঁর দাওয়াতী কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। দাদা সামনের রমজানে তাঁর পরিকল্পনা এবং চিন্তার কথা শুনিয়ে বলছিলেন.....এর পরের রমজান যদি না পাই? হঠাৎ করে, আমার মনে হলো আমি কি নিশ্চিত যে পরের রমজান আমি পাব? আসলে মৃত্যুর চিন্তা মানুষকে গুছিয়ে কাজ করতে সাহায্য করে- খুব ভাল মতই টের পেলাম। তবে হ্যাঁ, আরও একটি ব্যাপার আছে- ইহজীবন, তার পরের জীবন এবং এসবের স্রষ্টার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে স্বচ্ছ।

প্রায় পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ দাদা, যিনি দীর্ঘদিন থেকে হার্টের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁকে গ্রামে রাখতে অফিস থেকে একদিনের ছুটি নিলাম। বাসে দাদার সাথে খুব বেশি কথা হয়নি। গাড়ীর শব্দ, তার উপর দাদা কানে একটু কম শুনেন। গাড়ীতে থাকা অবস্থায় আমার কাছে একটিও ফোন এল না, কেবল দাদার মোবাইল টুংটুং করে বেজে উঠে। আত্নীয় স্বজনেরা তাঁর যাত্রা নিয়ে উদ্বিগ্ন আর তিনিই তাঁদের আশ্বস্ত করছিলেন। দাদা জানালার পাশের সিটে বসেছিলেন, আমি ছিলাম তাঁর পাশে। দুজনেই চুপচাপ বসে আছি। একবার ফোন আসল, রিসিভ করলেন। ফোন রেখে দিয়ে প্রায় অপ্রাসংগিকভাবেই বললেন, আমার আর সব ছেলে যদি তোমার আব্বার (এখানে উনি আমার আব্বার নাম বলেছিলেন) মত হতো! আবার নিরবতা, আমার চোখ ভিজে আসল...... সামনে ঝাপসা দেখলাম। খুব ভাল মতই একজন বৃদ্ধের আর্তি আমার মন ছুঁয়ে গেল। আমি খেয়াল করলাম, আসলে মানুষের কিছু অব্যক্ত ব্যথা থাকে যেগুলি অপ্রকাশিত থাকতেই পারে না। তিনি তাঁর সব সন্তানকেই সমান ভালোবাসেন সেটা বুঝেছি অন্য একটা ব্যাপারে, কিন্তু তিনি এমন সন্তান রেখে যেতে চান যে সন্তান তার মৃত্যুর পরে তার জন্য দোয়া করবে।

দাদা আরবী এবং ইংরেজি দুই ব্যকরণেই বেশ দক্ষতা রাখেন, তিনি মূলত ইংরাজীর ছাত্র ছিলেন। কিন্তু সেই আমলে হাই মাদ্রাসায় পড়ে আরবীটাও বেশ রপ্ত করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন, ইংরাজীর থেকে আরবী ব্যকরণ অনেক বেশি সহজ। আরবীতে ডেরিভেটিভ ওয়ার্ড অনেক বেশি, কেবল মুল ধরতে পারলে অর্থ বের করা সহজ হয়। ব্যকরণ জানা থাকলে কোরআন পড়ে মজা লাগে। তিনি কুরআনের প্রশংসা যখন করেন তখন তার মুখ থেকে 'ভারী সুন্দর' কথাটা শুনতে বেশ লাগে! শব্দ দুটির মধ্যে স্বতস্ফুর্ত আবেগ লক্ষ করি।

দাদার এই এক সপ্তাহের ঢাকা সফরে দাদা কি পেলেন জানি না, তবে আমি অনেক কিছুই পেয়েছি। জ্ঞান এবং সুন্দর জীবনবোধ থাকলে বৃদ্ধ বয়সেও মানুষ সুস্থ থাকতে পারে, প্রয়োজনীয় থাকতে পারে; সর্বোপরি এমনভাবে সে চলতে পারে যে- কেউ চাইলেই তাঁকে এক্সপ্লয়েট করতে পারে না, তাঁকে করুণা নিয়ে চলতে হয় না। আলহামদুলিল্লাহ! আই স্যালুট টু ইউ, মাই ডিয়ার দাদা!

5 comments:

যাযাবর said...

আপনার দাদার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে খুব। আমি যেখানেই এ ধরনের বৃদ্ধ/বৃদ্ধাদেরকে পাই গল্প করতে বসে যাই। ওনাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক অনেক কিছু শেখার থাকে।

বিসমিয়া said...

দাদা যেমন তার বড় ছেলের সবসময় প্রশংসা কেরেন তেমনি সব বড় ছেলের/মেয়ের উচিত দাদার বড় ছেলের মত হওয়া যে সব সময় দূরে থেকেও প্রতিদিন মোবাইলে ২/৩ বার বাবা মায়ের খোঁজ খবর নিবে।

মাহমুদ রহমান said...

হ্যাঁ, সত্যিই ফারজানা আপু, দাদার সাথে গল্প করে আপনি বেশ মজাই পেতেন। বেশ রসিক মানুষ। তিন/চার দিন থেকে দাদা বলে কি দুই মাস হয়ে গেল; এখন বাড়ী যাই। আরে দুই মাস কোথায়? আসলেন তো সেদিন। কেন? জুলাইতে না আসলাম; এখন তো আগস্ট মাস!

@ বিসমিয়া, তোর জন্য তো দেখি লিখালিখি বন্ধ করে দিতে হবে! আমার অতো টাকা নাই, উনারাই ফোন করলে আমি কি করব!

umm_abdullah said...

মাহমুদ, তোমার দাদাজানকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম। উনার কথা শুনতে খুব ভাল লাগে। বিশেষত উনি যেরকম বুদ্ধিমান মানুষ। এ যুগে এমন মানুষ বিরল।

ochena_pothik said...

খুব ভাল লাগল আপনার দাদার সাথে সময় কাটানোর গল্প শুনে। আপনার তো দাদা আছে গল্প করার জন্য, সময় কাটানোর জন্য....অনেকের ভাগ্যেই তা জুটে না।

আপনার লেখা পড়ে কল্পনায় আমার নিজের দাদাকে দেখছি। আমার দাদাকে কেবল আমি কল্পনায়ই দেখেছি। বাস্তবে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আমার জন্মের ৫ মাস আগেই দাদা পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন.....।

আল্লাহ আপনার দাদাকে দীর্ঘ এবং সুস্থ হায়াত দিন। আমীন।